- 12 September, 2022
- 0 Comment(s)
- 359 view(s)
- লিখেছেন : তামান্না
‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে প্রচলিত সংস্কারের বিরুদ্ধে গিয়ে, নারী-সম্পর্কের চিরকালীন মূল্যবোধের বেড়াজাল ভেঙে, সম্পূর্ণ নতুন এক রক্তমাংসের নারীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘কুসুম’-কে প্রাণবন্ত ভাবে উপন্যাসে উপস্থাপিত করেছেন মানিকবাবু। একই সঙ্গে লেখক, কুসুমের দেহ ও মনের চাহিদার ব্যাপারটি সঙ্কোচহীন ভাবে তুলে ধরেছেন উপন্যাসে। গ্রামবাংলার তেইশ বছরের ‘বাঁজা মেয়ে’ কুসুম, সে পাঁচটা মেয়ের মত সাধারণ ছিল না। সে ছিল চঞ্চল, লাগামহীন, জটিল। তাঁর একঘেয়ে গতে বাঁধা জীবনে কোন আনন্দ ছিল না। গাওদিয়া গ্রাম অসহ্যকর হয়ে উঠেছিল তাঁর কাছে। তাঁর নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎ একদিন খুশির হাওয়ার লাগল নাচন ডাক্তার শশীর আবির্ভাবে। ডাক্তারকে সে মনেমনে পছন্দ করতে শুরু করেন। তবে সে সহজে তাঁর অনুরাগের কথা শশীর কাছে প্রকাশ করতে পারেন না। ফলে স্বভাবতই তাঁর মনের অবদমনের ফলে, তাঁর জীবন এবং উপন্যাসের কাহিনিতে জটিলতার সৃষ্টি হয়। কুসুমের ননদ মতির প্রতি শশীর আসক্তি দেখে কুসুম ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন।
কুসুমের দাম্পত্য জীবন সুখময় ছিল না। কুসুম বর পরানকে পছন্দ করতেন না। কুসুম তাঁর জীবনে একজন পুরুষালি মানুষকে চেয়েছিলেন, পরানের প্রতি সবসময় তাঁর অবজ্ঞা ঝরে পড়ত। স্বাধীনচেতা কুসুম নিজের শারীরিক ও মানসিক শান্তির জন্য অকপটে তাঁর মনের কথা ঘোষণা করেছেন। ঠুনকো সমাজ,সংস্কারের কাছে হয়তো সে মন্দ মেয়ে, কিন্তু সে অনায়াসে শশীকে বলেছেন- “এমনি চাঁদনী রাতে আপনার সঙ্গে কোথাও চলে যেতে সাধ হয় ছোটবাবু।” আবার শরীরের কথাও কুসুম উচ্চারণ করেছেন দ্বিধাদ্বন্দ্বকে পাশে সরিয়ে রেখে-
“আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন করে কেন ছোটবাবু?”
এই উপন্যাসে বরং শশীকে অনেক সংস্কারী রূপে ঔপন্যাসিক পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। কুসুমের মত বলিষ্ঠ ভাবে কিন্তু শশীকে তুলে ধরা হয়নি। সামাজিকতা, সমাজকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে শশী, কুসুমকে অবজ্ঞা করেছেন। তাঁর পক্ষে কখনো সম্ভব ছিলনা সধবা একজন নারীকে গ্রহণ করা। কুসুম সাহসিকতার সঙ্গে পতিপরমদেব ধারণাকে দূরে সরিয়ে রেখে, নিজের ভাললাগা-ভালবাসা-শরীর নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। এত সাহসী নারীকে দেখে শশী ভয় পেয়েছেন। তাই সে কুসুমকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতে পারেননি। হয়তো সেই কারণে ভড়কে গিয়ে কুসুমকে বলে উঠেছেন-
“শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম?”
কুসুমের কাছে শরীর ও মন দুটি সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আবার কুসুম তাঁর আত্মসম্মান নিয়ে সচেতন ছিলেন। দীর্ঘদিন কুসুম শশীর তাচ্ছিল্য সহ্য করেছেন, তারপর সে একদিন সিদ্ধান্ত নেয় বাবার বাড়ি ফিরে যাবেন। ঠিক এইসময় শশীর কুসুমের প্রতি প্রেম জেগে ওঠে। শশী তখন কুসুমকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে চান। অকস্মাৎ এইসব বিষয় দেখে কুসুম গদগদ হয়ে পড়েননি। ধীর-স্থির ভঙ্গিতেই সে তাঁর মনের কথা শশীকে জানিয়েছিলেন। রাতারাতি শশীর পরিবর্তন দেখে কুসুমের মনের নির্লিপ্ততা বেশি করে ফুটে উঠেছে। তাই সে শশীর নিবেদনে সাড়া দেননি। নিজের মনের কথা দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন-
“... আজ হাত ধরে টানলেও আমি যাব না।”
কপিলা ও কুসুমকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গড়েছিলেন – নির্ভীক ভাবে। তাঁরা তাঁদের নিজেদের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে সচেতন ছিলেন। নিজের জীবনকে নতুন ভাবে সাজাতে কপিলা ময়নাদ্বীপের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছেন। কুসুম তাঁর আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে চেয়েছেন, একদা শশীর প্রেমে পাগলিনী নিজের সম্মানকে হেলায় হারিয়ে দেননি, তাঁর তীব্র ব্যক্তিত্বের দীপ্তির কাছে শশী ফিকে হয়ে গেছেন। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় যেখানে নারী শরীরের শুচিতা নিয়ে জিগির তুলছেন আসমুদ্রহিমাচল, সেইখানে মানিকের উপন্যাসের সৃষ্ট নারীরা আবর্ত ভেঙে গড়েছেন অন্য এক ভুবন।
0 Comments
Post Comment